শুধু তিনি নিজে স্বাবলম্বী হননি বর্তমানে তার অধিনে দুই শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু তার এ স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে ওঠা একদিনে হয়নি। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল তাকে এ পর্যায়ে আসতে সহায়তা করেছে। শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তিলে তিলে তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন।
বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার সানকিভাঙা গ্রামের আব্দুল জলিল এবং হাওয়া বেগম দম্পতির দুই মেয়ের মধ্যে মনিরা সুলতানা বড়। এই গ্রামেই তার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে। তবে বর্তমানে রূপসার নৈহাটী ইউনিয়নের কিসমত খুলনা (খোড়ার বটতলা) গ্রামে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন অভাব অনটনের মধ্যে তার পড়ালেখা, বেঁচে থাকার তাগিদে সংসারের হাল ধরার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কাহিনী।
মনিরা সুলতানা বলেন, ‘বাবা আব্দুল জলিল সামান্য একজন গাড়ি চালক এবং মা হাওয়া বেগম গৃহিনী। দুই বোনের মধ্যে বড় তিনি। এলাকার জাহানাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লেখার পর অভাব-অনটনের তাড়নায় কাজের সন্ধানে ২০০১ সালে মা তার দুই সন্তান নিয়ে রূপসা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সিঅ্যান্ডবি কলোনিতে এসে ওঠেন। তখন একটি দুর্ঘটনার মামলায় তার বাবা জেলখানায় ছিলেন। ফলে সংসারের হাল ধরার কেউ ছিল না।
অভাবের তাড়নায় কিশোরী বয়সেই মনিরা চররূপসা বায়োনিক সি ফুডস-এ চাকরির জন্য যান। তার পরিবারের কথা শুনে ফ্যাক্টরির তৎকালীন জি এম জিন্নাত সাহেব সহযোগিতার হাত বাড়ান। মাত্র ১৬৫০ টাকা বেতনে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। একই সময় জিন্নাত সাহেবের মহানুভবতায় তিনি রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন।’
‘২০০৬ সালে এসএসসি পাসের পর তিনি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসিও পাস করেন।
একটা সময়ে বায়োনিক সি ফুডস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি শিক্ষার পাশাপাশি পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে মডার্ণ সি ফুডস-এ মাননিয়ন্ত্রণ (কিউসি) শাখায় চাকরি নেন। তখন ৩ হাজার ৫শ’ টাকা বেতন পেতেন। এখানে যোগদানের পর খুলতে থাকে তার ভাগ্যের চাকা। তৎকালীন কারখানা ম্যানেজার শফিউল্লাহ খান মিলন মনিরার কাজে খুশি হয়ে কোম্পানির প্রয়োজনীয় চায়না প্রোডাক্ট স্কয়ার স্টিক বা বাম্বু স্টিক তৈরি করে সাপ্লাই দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। হাতে স্যাম্পল তুলে দেন। বাঁশের তৈরি এ বাম্বু স্টিক বাগদা চিংড়ির দেহ সোজা রাখতে সহায়তা করে।
মনিরা সুলতানা মডার্ণ সি ফুডসে চাকরির পাশাপাশি কিসমত খুলনার এলাকার গুরু ও হরি নামে দুই ব্যক্তির সাথে বাম্বু স্টিক স্যাম্পল নিয়ে কথা বলেন। তারা মনিরার অর্ডার নিলেন এবং বাম্বু স্টিক তৈরি শুরু করেন। এরপর তার শুরু হয় এগিয়ে যাওয়ার পালা।’
মনিরা সুলতানা বলেন, ‘২০০৫ সালের দিকে গ্রামের মাত্র ১০ জন নারী নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে বাম্বু স্টিক তৈরির কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় দু’শতাধিক নারী শ্রমিক কর্মরত। প্রতি বছর মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তার কারখানায় চায়না এ প্রোডাক্ট তৈরির কাজ চলে।
এসব পণ্য এসএ পরিবহনের মাধ্যমে খুলনা, ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন মাছ কোম্পানিতে বিক্রি করা হয়। প্রতি হাজার বাম্বু স্টিক ৩০০ থেকে প্রকার ভেদে ৬০০ টাকা দামে বিক্রি করা হয়। চায়না এ বাম্বু স্টিকের সাইজ থাকে ৩-১২ ইঞ্চি পর্যন্ত। এ পণ্যটি এখন ভারতের বারাসাত এলাকার বিভিন্ন মাছ কোম্পানিতেও রপ্তানি করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাম্বু স্টিক তৈরির পাশাপাশি ২০০৯ সালে তিনি ইন্টারন্যাশনাল লেবার ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের শেষের দিকে এ তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে তিনি বাম্বু স্টিক তৈরি কারখানায় পুরোপুরি সময় ব্যয় করছেন। বর্তমানে তিনি একজন নারী হিসেবে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নানা কর্মকাণ্ডে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও তাদের একজন অংশীদার হয়ে দেশকে আরও এগিয়ে নিতে চাই। রূপসা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তাহিরা খাতুন বলেন, ‘এ বছর উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পাওয়ার দাবিদারদের মধ্যে একজন নারী উদ্যোক্তা মনিরা সুলতানা।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর নারী উদ্যোক্তাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করা হয় এবং বেগম রোকেয়া দিবসে পুরস্কৃত করা হয়।